ভারতের প্রথম নিজস্ব নৌবহরের উত্থান: স্বদেশী ও সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির বীরগাথা
- kousik pattanayak
- May 3
- 2 min read
Updated: 3 days ago
বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে, একদিন যে স্বপ্ন দেখেছিলেন কয়েকজন দূরদর্শী ভারতীয়, তা রূপ নেয় দুটি সাহসী শিপিং কোম্পানির উত্থানে। এই কোম্পানিগুলো শুধু বাণিজ্য নয়, বরং পরাধীন ভারতের বুকে স্বনির্ভরতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। আসুন, সেই ঐতিহাসিক যাত্রার সঙ্গী হই...
স্বদেশী স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি: যখন সাহসের অপর নাম ছিল চিদাম্বরম পিল্লাই
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ব্রিটিশদের একচ্ছত্র আধিপত্য ভারতীয় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিল। শিপিং শিল্পও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এই পরিস্থিতিতে, ভি. ও. চিদাম্বরম পিল্লাইয়ের মতো একজন বিপ্লবী স্বপ্ন দেখেন এক সম্পূর্ণ ভারতীয় মালিকানাধীন শিপিং কোম্পানির। ১৯০৬ সালে জন্ম নেয় স্বদেশী স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি (Swadeshi Steam Navigation Company)।
এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ মালিকানাধীন শিপিং কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য কমানো এবং ভারতীয় বণিকদের স্বাবলম্বী করে তোলা। চিদাম্বরম পিল্লাইয়ের অদম্য সাহস এবং দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল এই উদ্যোগ। তুতিকোরিন ও শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের মধ্যে স্বাধীন জাহাজ চলাচল শুরু করে এই কোম্পানি, যা ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক স্বার্থে বড় আঘাত হানে।
ব্রিটিশ সরকার বিভিন্নভাবে এই কোম্পানির উপর বাধা সৃষ্টি করে, এমনকি চিদাম্বরম পিল্লাইকে কারারুদ্ধও করা হয়। কিন্তু তাঁর দেখানো পথ ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। স্বদেশী স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি প্রমাণ করে যে, প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভারতীয়দের নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার সাহস এবং সক্ষমতা রয়েছে।

সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি: কলকাতার বুকে প্রথম ভারতীয় বাণিজ্যিক ঢেউ
ঠিক একই সময়ে, ভারতের অন্য প্রান্তে, বিশেষ করে বাণিজ্যনগরী কলকাতায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপিং কোম্পানির জন্ম হয়। ১৯১৯ সালে নারোত্তম মোরারজির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি (Scindia Steam Navigation Company), যা কলকাতার প্রথম ভারতীয় মালিকানাধীন শিপিং কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
এই কোম্পানির প্রথম জাহাজ ছিল Loyalty, যা ১৯১৯ সালেই যুক্তরাজ্যে যাত্রা করে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করে। সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের শিপিং একচেটিয়া ভেঙে ভারতীয় বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। নারোত্তম মোরারজির ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা এবং দৃঢ় সংকল্প এই কোম্পানিকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেয়।
কলকাতায় একটি স্বতন্ত্র শিপিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ভারতীয় বাণিজ্যের জন্য এক বিশাল সুযোগ তৈরি করে। এর মাধ্যমে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সরাসরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পান, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে সমুদ্রপথ: শিপিং কোম্পানির অবদান
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এই শিপিং কোম্পানিগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। একদিকে যেমন তারা ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিকল্প তৈরি করেছিল, তেমনি অন্যদিকে দেশের প্রয়োজনেও নিজেদের নিয়োজিত করেছিল।
যদিও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কর্তৃক ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বিনামূল্যে জাহাজ সরবরাহের কাহিনী ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত, তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতীয় ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলি দেশের প্রয়োজনে সর্বদা এগিয়ে এসেছিল। এই কোম্পানিগুলো দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের নৈতিক ভিত্তিকেও মজবুত করেছিল।
উপসংহার: ঐতিহ্যের ঢেউ আজও বহমান
ভারতের এই দুই অগ্রণী শিপিং কোম্পানি শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের কাহিনী নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আত্মনির্ভরতার প্রতীক। তাদের সাহসী পদক্ষেপ এবং দেশপ্রেম আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আজকের দিনে ভারতের যে শক্তিশালী নৌ-বাণিজ্য ব্যবস্থা, তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এই ঐতিহাসিক উদ্যোগগুলোর হাত ধরেই। এই কোম্পানিগুলো প্রমাণ করে যে ইচ্ছাশক্তি ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা দিয়ে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
এই ঐতিহাসিক কোম্পানিগুলো সম্পর্কে আপনার আরও কিছু জানা আছে কি?
কমেন্ট করে আমাদের জানান।
(প্রথম ভারতীয় শিপিং কোম্পানি, Scindia Steam Navigation, Swadeshi Steam Navigation, কলকাতার প্রথম শিপিং কোম্পানি, ভারতীয় শিপিং ইতিহাস, ভি. ও. চিদাম্বরম পিল্লাই, নারোত্তম মোরারজি, ভারতীয় নৌ কোম্পানি, ব্রিটিশ শিপিং, স্বাধীনতা সংগ্রাম।)
コメント