১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: কারণ, ফলাফল এবং প্রভাব
- kousik pattanayak
- May 5
- 3 min read
Updated: 3 days ago
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক সংঘাত। এই যুদ্ধ কেবল দুটি দেশের ইতিহাসেই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হলেও, এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মূল কারণ, যুদ্ধের ঘটনাক্রম, তাশখন্দ চুক্তির তাৎপর্য, ভারতের অর্জন, যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের পরিবর্তিত অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

যুদ্ধের মূল কারণ: কাশ্মীর বিতর্ক ও অপারেশন জিব্রাল্টার
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকেই কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও, কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং ভারতের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং বিভিন্ন সময়ে কাশ্মীরকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল কাশ্মীর ইস্যু।
এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে, পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ নামে একটি গোপন সামরিক অভিযান শুরু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল গেরিলা অনুপ্রবেশের মাধ্যমে কাশ্মীরের স্থানীয় জনগণকে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উৎসাহিত করা এবং অঞ্চলটি দখল করা। তবে পাকিস্তানের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে তেমন কোনো সমর্থন না পেয়ে, অনুপ্রবেশকারী সেনারা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায়।
এর পাশাপাশি, ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে রান অফ কচ্ছ অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। যদিও এই সংঘর্ষ একটি আপোষের মাধ্যমে মীমাংসা হয়, তবে এর ফলে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়।
যুদ্ধের বিস্তার: লাহোরে ভারতের পাল্টা আক্রমণ
অপারেশন জিব্রাল্টারের ব্যর্থতার পর, পাকিস্তান সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। এর জবাবে, ভারত ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ তারিখে পাকিস্তানের লাহোর শহরে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। ভারতের এই পদক্ষেপ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাঞ্জাব ও রাজস্থানের সীমান্তজুড়ে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী ও স্থল বাহিনী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে সক্ষম হয়।
কাশ্মীরেও দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই চলে। ভারতীয় সেনারা সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করে এবং হাজী পীর পাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এই সময়, ভারতীয় সৈন্যদের বীরত্ব ও দেশপ্রেম দেশের জনগণের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।

তাশখন্দ চুক্তি: শান্তির পথে পদক্ষেপ
দীর্ঘদিনের যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে, উভয় দেশ আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ১০ জানুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে উজবেকিস্তানের তাশখন্দে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ‘তাশখন্দ চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ:
* উভয় দেশ যুদ্ধ শুরুর আগের সীমান্ত অবস্থানে ফিরে যাবে।
* ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে।
* কোনো দেশ একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
তাশখন্দ চুক্তি যদিও তাৎক্ষণিকভাবে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল, তবে কাশ্মীর সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি।
ভারতের অর্জন: সামরিক সক্ষমতা ও জাতীয় মনোবল
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন লাভ করে। প্রথমত, ভারতীয় সেনারা কাশ্মীরকে রক্ষা করতে সফল হয় এবং পাকিস্তানের আগ্রাসী পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়। দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধ ভারতের সামরিক সক্ষমতাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে এবং দেশের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
এই যুদ্ধের সময় "জয় জওয়ান, জয় কিষান" (সৈনিকের জয়, কৃষকের জয়) স্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও সামরিক শক্তির মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ককে তুলে ধরে এবং জাতীয় ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করে।
যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল ভারতের অর্থনীতিতে। দীর্ঘদিনের সংঘাতের কারণে প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার PL-480 প্রোগ্রামের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি করতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৬৬ সালে ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়ন করা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি অংশ ছিল। যদিও যুদ্ধের আনুমানিক ব্যয় নির্ধারণ করা কঠিন, তবে এটি স্পষ্ট যে এই সংঘাত ভারতের অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছিল।
ভারতের বৈশ্বিক অবস্থানের পরিবর্তন
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের অবস্থানকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলে। সামরিকভাবে নিজেদের দৃঢ়তা প্রমাণ করার ফলে, বিশ্ব মঞ্চে ভারতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভারতকে সমর্থন জুগিয়েছিল।
অন্যদিকে, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ কমতে থাকে। যুদ্ধের পর অনেক দেশই ভারতের অবস্থানকে বুঝতে শুরু করে এবং পাকিস্তানের আগ্রাসী নীতিকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকে।
উপসংহার
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই যুদ্ধ একদিকে যেমন দুটি দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতার জন্ম দেয়, তেমনি অন্যদিকে ভারতের সামরিক সক্ষমতা ও জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। তাশখন্দ চুক্তি শান্তির একটি ক্ষীণ আশা জাগালেও, কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান অধরা থেকে যায়। এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, যা আজও ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।
コメント